গাজরের উপকারিতা ও অপকারিতা - গর্ভাবস্থায় গাজর খাওয়া যাবে কি জেনে নিন বিস্তারিত
গাজর একটি শীতকালীন সবজি হওয়ার সত্ত্বেও বর্তমানে এটি সারা বছরই পাওয়া যায়। গাজর চিনি না এমন লোক পাওয়া মুশকিল। তবে আমাদের মধ্যে অনেকেই গাজর খেতে পছন্দ করলেও কিছু কিছু মানুষ গাজর খেতে পছন্দ করেন না। তবে তারা যদি এর উপকারিতা সম্পর্কে অবগত হতো তবে অবশ্যই গাজর খাওয়ার প্রতি আকর্ষিত হতো।
গাজর আমাদের শরীরের বিভিন্ন ভিটামিনের অভাব পূরণের পাশাপাশি এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে থাকে। এছাড়াও গাজর আরো অনেক ধরনের উপকার করে থাকে। তবে গাজর যে শুধু আমাদের উপকার করে তা কিন্তু নয়। গাজরের কিছু ক্ষতিকরটি রয়েছে। যেগুলোর কারণে গাজর খাওয়ার প্রতি কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
এই আর্টিকেলে আমরা গাজরের উপকারিতা ও অপকারিতা আলোচনা করার পাশাপাশি আরো অনেক বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করব। আপনারা যদি এই আর্টিকেলটি সম্পন্ন করে থাকেন তবে সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন। তাহলে চলুন দেরি না করে আর্টিকেলটি শুরু করা যাক।
গাজর খাওয়ার নিয়ম
আমরা কম বেশি সকলেই জানি যে গাজরে অনেক পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান। তবে আমাদের মধ্যে একটি প্রশ্ন কাজ করে যে, কাঁচা নাকি রান্না করা গাজরের মধ্যে পুষ্টি উপাদান বেশি? কেননা আমরা অনেকেই ভেবে থাকি কাঁচা গাজরে পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ রান্না করা গাজরের তুলনায় বেশি থাকে। আবার অনেকে এর উল্টোটাও ভেবে থাকেন।
এক্ষেত্রে পুষ্টি বিষয়ক একটি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে যেখানে রান্না করা ও কাঁচা গাজরের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে গাজরে যেসব পুষ্টি উপাদান থাকে তার মধ্যে অন্যতম হলো বিটা ক্যারোটিন/ক্যারোটিনয়েড। অন্য বেশি ভাগ উপাদান তাপে নষ্ট হয়ে গেলেও বিটা ক্যারোটিন/ ক্যারোটিনয়েড তাপ পেলে তা শরীরের জন্য আরো উপকারী হয়।
বিটা কেরোটির হলো এক প্রকার প্রোবিটামিন যা শরীরে পরবর্তীতে ভিটামিন-এ তে রূপান্তরিত হয়। গাজরে বিদ্যমান বিটাকারোটিন তাপে নষ্ট না হওয়ার কারণে এটি মাঝারি আঁচে নরম না হওয়া পর্যন্ত রান্না করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে এর পুষ্টিগুণ আগুন অক্ষুন্ন থাকে এবং তা সহজে হজম হয়। তবে এখন আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে তাহলে কি কাঁচা গাজর খাওয়া ঠিক নয়?
কাঁচা অবস্থায় গাজর খেলেও এর থেকে অনেক বেশি উপকার পেতে পারেন। কেননা গাজরের নিজস্ব কিছু উপকারিতা রয়েছে যেগুলো আপনি যেকোন অবস্থায় গাজর গ্রহণ করে পেতে পারেন। এছাড়াও গাজরে বিদ্যমান আঁশ, পটাশিয়াম, লুটেইনসহ বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান কাঁচা অবস্থায় গ্রহণের ফলে পাওয়া যায়।
তবে কাঁচা অবস্থায় গাজর খাওয়ার সময় খোসা ছাড়িয়ে নেওয়া উচিত। কেননা খোসাসহ খেলে তা হজমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। এছাড়াও গাজর যে অবস্থায় খাওয়া হোক না কেন এটিকে প্রথমে ভালোভাবে ধুয়ে তারপর খেতে হবে। আপনি চাইলে কাঁচা গাজর সালাত বানিয়ে খেতে পারেন। এছাড়াও অনেকে গাজরের হালুয়া খেতে পছন্দ করে। আপনি চাইলে এভাবেও খেতে পারেন।
গাজরের জুস আমাদের শরীরের জন্য অনেক বেশি উপকারী। আপনি যদি চান তবে গাজরকে জুস বানিয়ে খেতে পারেন। এছাড়া আপনি গাজরকে অন্যান্য সবজির সাথে মিশিয়ে খেতে পারেন। মোটকথা আপনি গাজরকে যেভাবে খান না কেন এতে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদানের সবগুলো পাওয়া সম্ভব। তাই গাজরের অনেক উপকারিতা থাকার কারণে আমাদের উচিত নিয়ম করে গাজর খাওয়া।
প্রতিদিন কতটুকু গাজর খাওয়া উচিত
আমরা সকলেই কম বেশি জানি যে গাজরে প্রচুর পরিমাণ পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান। আর ঠিক এই কারণেই আমরা অনেকেই প্রচুর পরিমাণ গাজর খাওয়ার চিন্তা করে থাকি। কিন্তু আপনি কি জানেন আমাদের প্রতিদিন কতটুকু গাজর খাওয়া উচিত? আমার ধারণা অনেকের মনেই এই প্রশ্নের উদ্ভব ঘটেছে। তাহলে আসুন এই সম্পর্কে আলোকপাত করা যাক।
আমাদের শরীরের জন্য অতিরিক্ত কোন কিছুই ভালো নয়। হোক না সেটা যতই পুষ্টিকর। গাজরের ক্ষেত্রেও ঠিক একই। গাজরে অনেক পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান থাকার কারণে যদি কেউ অতিরিক্ত পরিমাণ গাজর খেয়ে ফেলে তবে সেটি তার জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ দিনে সর্বোচ্চ ৩/৪ টি মাঝারি সাইজের গাজর খেতে পারেন। এতে করে তার পুষ্টি চাহিদা পূরণ হয়ে যাবে।
আমরা যারা গাজরের জুস খেতে পছন্দ করি তারা দিনে সর্বোচ্চ এক গ্লাস গাজরের জুস খেতে পারি। এর বেশি খেলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এছাড়াও গাজর বেশি খাওয়ার ফলে এতে বিদ্যমান ভিটামিন এ বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে। এজন্য একজন মানুষ প্রতিদিন মাঝারি সাইজের ৩/৪ টি গাজর অথবা ১৫০ থেকে ২০০ গ্রাম গাজর খেতে পারে। এর বেশি নয়।
অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় এতটুকু গাজর খাওয়ার ফলে ও শরীরে বিভিন্ন ধরনের এলার্জি ও অস্বস্তি দেখা দিচ্ছে। তাদের ক্ষেত্রে আরো কম খেতে হবে। যতটুকু খেলে তার কোন সমস্যা হবে না ঠিক ততটুকু খেতে হবে। তাহলেই এর থেকে পরিপূর্ণ উপকার পাওয়া সম্ভব।
কাঁচা গাজর খাওয়ার উপকারিতা
শীতকালে যে সব পুষ্টিকর সবজি পাওয়া যায় তার মধ্যে গাজর অন্যতম। গাজর রান্না করার থেকে কাঁচা অবস্থায় খেতেই মানুষ বেশি পছন্দ করে থাকে। গাজরে অনেক পুষ্টির প্রধান বিদ্যমান থাকার কারণে কাঁচা অবস্থায় এটি খেলে তা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অনেক বেশি উপকারী। নিয়মিত কাঁচা গাজর খেলে তা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
এছাড়াও গাজরে রয়েছে প্রচুর পরিমান পানি। কাঁচা অবস্থায় খাওয়ার ফলে এটি আমাদের শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও শরীরের বিভিন্ন সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে কাঁচা গাজর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
আমাদের অনেকেরই দেখা যায় অতিরিক্ত পরিমাণে মাথার চুল পড়ে যায়। এটি মূলত ভিটামিনের অভাবে হয়ে থাকে। তা এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য আমরা নিয়মিত কাঁচা গাজর খেতে পারি। কাঁচা গাজরে বিদ্যমান ভিটামিন চুল পড়া রোধে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে। এছাড়াও ত্বক ফর্সা করতে কাঁচা গাজরের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
এছাড়াও কাঁচা গাজর আমাদের মেটাবলিজম বাড়াতে সাহায্য করে, শরীর থেকে দূষিত পদার্থ বের করে দেয়, ব্রণের সমস্যার সমাধান, ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য সহ নানা ধরনের উপকার করে থাকে। তাই এসব উপকার পেতে কাঁচা গাজর খাওয়ার কোন বিকল্প নেই।
গাজর খেলে কি ওজন বাড়ে
আমরা হয়তো অনেকেই ভেবে থাকি গাজর খেলে ওজন বাড়ে। কিন্তু আমাদের এই ধারণা একদমই ভুল। গাজর আমাদের ওজন বাড়ায় না বরং এটি আমাদের শরীরের মেদ ঝরাতে সাহায্য করে থাকে। কুষ্টিবিদদের মতে ১০০ গ্রাম গাজরে ১০.৬ গ্রাম শর্করা এবং ০.২ গ্রাম চর্বি বিদ্যমান থাকে। যা প্রতিদিনের গ্রহণকৃত অন্যান্য খাবারের তুলনায় কম। এছাড়াও এতে প্রচুর পরিমাণ ফাইবার থাকার কারণে দীর্ঘক্ষন ক্ষুধা অনুভূত হয় না। এ কারণে প্রতিদিনের খাবার তালিকায় গাজন রাখলে তা মেদ ঝরবে।
এছাড়াও গাজরে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ পানি যা আপনাকে হাইড্রেটেড রাখতে সাহায্য করে থাকে। আর আমরা সবাই জানি ওজন কমানোর ক্ষেত্রে হাইড্রেটেড থাকা অনেক বেশি জরুরী। এছাড়াও গাজরের রসে বিদ্যমান ভিটামিন বি বিপাক ক্রিয়া শক্তিশালী করে। যার ফলে শরীর দ্রুত ক্যালোরি পোড়ায়, যা ওজন কমাতে সাহায্য করে।
এছাড়াও দ্রুত ওজন কমানোর জন্য কয়েক টুকরো গাজর ভালো করে সিদ্ধ করে তাতে সামান্য লবণ ও গোলমরিচ দিয়ে খেতে পারেন। এছাড়াও গাজর, আদা, দারচিনির গুঁড়া, লেবুর রস একসঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে একটি পানীয় তৈরি করে খেতে পারেন। এতেও দ্রুত মেদ ঝরে যাবে।
এজন্য পুষ্টিবিদ এবং ডাইটিসিয়ানরা ওজন কমানোর ক্ষেত্রে সুষম খাবারের অংশ হিসেবে গাজর খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কেননা এতে বিদ্যমান ছয়বার ও কম ক্যালোরি দ্রুত ওজন কমাতে সাহায্য করে। আর এ কারণেই গাজর খেলে ওজন বাড়ে না বরং এটি ওজন কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
প্রতিদিন গাজর খাওয়ার উপকারিতা
সুস্থতা মহান আল্লাহ তা'আলার একটি বড় নেয়ামত। প্রতিটি মানুষই নিজেকে সুস্থ রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে। আর শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য শাক সবজির বিকল্প নেই। কেননা শাকসবজিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ খনিজ, ভিটামিন, প্রোটিন, আমিষ সহ সকল প্রকার পুষ্টি উপাদান। আর এসব সবজির মধ্যে গাজরকে স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী মনে করা হয়।
কেননা এতে রয়েছে ভিটামিন, আয়রন, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়ামসহ বিভিন্ন ধরনের পুষ্টি উপাদান। গাজর মূলত শীতকালীন সবজি হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে এটি সারা বছরই পাওয়া যায়। তাই বিশেষজ্ঞগণ এর পুষ্টিগুণার কথা চিন্তা করে সুষম খাদ্য তালিকার অংশ হিসেবে গাজর রাখতে বলেন। এই পর্বে আমরা গাজরের স্বাস্থ্য উপকারিতা সম্পর্কে জানব। তাহলে চলুন গাজরের উপকারিতা গুলো জেনে নেয়া যাক-
দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে
গাজরে প্রচুর পরিমাণ বিটা ক্যারোটিন বিদ্যমান থাকে। আর এই বিটা ক্যারোটিন শরীরে ভিটামিন এ তে পরিবর্তিত হয়। আমাদের চোখের রেটিনায় অবস্থিত রড ও কোণ কোষের জন্য অপরিহার্য একটি উপাদান হলো ভিটামিন এ। এই ভিটামিন চোখের দৃষ্টি শক্তি বৃদ্ধিতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে। সেই সাথে এটি চোখে ছানি করার হাত থেকে রক্ষা করে এবং রাতকানা প্রতিরোধ করে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে
গাজরের প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বিদ্যমান থাকে। এগুলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। সেই সাথে শরীরকে বিভিন্ন রোগের হাত থেকে রক্ষা করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে
গাজরের বিদ্যমান ফ্যালকারিওনল ও ফ্যালকারিনডিওল নামে দুটি ক্যান্সার প্রতিরোধী যৌগ শরীরে ক্যান্সার কোষ বৃদ্ধিতে বাধা প্রদান করে থাকে। ফলে শরীরে নতুন করে কোন ক্যান্সার কোষ বাসা বাঁধতে পারে না। সেইসাথে এটি ক্যান্সার কোষ ধ্বংসতেও কাজ করে থাকে। এর ফলে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। নিয়মিত গাজর খাওয়ার ফলে বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার কেমন প্রোস্টেট ক্যান্সার, ফুসফুস ক্যান্সার, কলোরেক্টাল ক্যান্সার ইত্যাদি হওয়ার প্রবণতা কম থাকে।
হজম শক্তি বৃদ্ধিতে
গাজরে প্রচুর পরিমাণ খাইবার বিদ্যমান থাকায় একটি হজম শক্তিকে উন্নত করতে সাহায্য করে। এছাড়াও এটি কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এছাড়াও যারা দীর্ঘদিন ধরে পেটের বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছেন তাদেরকে পেটের সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে গাজরের অবদান অনেক।
ওজন কমাতে
গাজরে প্রচুর পরিমাণ ফাইবার বিদ্যমান থাকার কারণে এটি খাওয়ার ফলে দীর্ঘক্ষণ পেট ভরে থাকে। সেই সাথে গাজরের অন্যান্য খাবারের তুলনায় ক্যালোরি কম থাকে। এ কারণে গাজর খাওয়ার ফলে শরীর অতিরিক্ত ক্যালরি সঞ্চয় করতে পারে না। যার ফলে ওজন কমে যায়। এছাড়াও গাজরে পানি বিদ্যমান থাকার কারণে এটি শরীরের চর্বি ঝরাতে সাহায্য করে। তাই ওজন কমাতে চাইলে নিয়মিত গাজর খেতে পারেন।
লিভারকে সুস্থ রাখতে
গাজরে প্রচুর পরিমাণ ফাইবার বিদ্যমান থাকায় এটি লিভার এবং কোলনকে মলত্যাগের উদ্দীপনা দিয়ে পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। এছাড়াও এটি লিভারের প্রদাহ, ফোলা ভাব ও সংক্রমণ কমাতে সাহায্য করে থাকে। এছাড়াও একটি লিভারের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা যেমন সিরোসিস, হেপাটাইটিস ইত্যাদির হাত থেকে লিভার কে রক্ষা করতে সাহায্য করে।
ত্বককে উজ্জ্বল রাখতে ও ত্বকের বলিরেখা দূর করতে
গাজরের প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন এ বিদ্যমান থাকায় এটি কোষের বৃদ্ধি ও পুনর্জন্মে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এর ফলে ত্বকের দাগছোপ, ত্বকের বলিরেখা ও ব্রণের দাগ দূর করতে সাহায্য করে। ফলে ত্বক আরো বেশি উজ্জ্বল ও সুন্দর হয়। সেই সাথে এটি ত্বকের রোদে পোড়া ভাব দূর করতে সাহায্য করে।
ত্বকের আদ্রতা ধরে রাখতে
শীতকালে আমাদের সকলের ত্বকই শুষ্ক হয়ে যায়। আর এই গাজর ত্বককে শুষ্কতার হাত থেকে রক্ষা করে। কেননা গাজরে প্রচুর পরিমাণ পটাশিয়াম বিদ্যমান থাকে যার ত্বকের আদ্রতা ভাব ফিরিয়ে আনে এবং ত্বককে শুষ্কতার হাত থেকে রক্ষা করে।
চুল পড়া রোধে
চুল পড়া রোধে গাজর কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে। গাজরে বিদ্যমান ভিটামিন ও মিনারেল চুল পড়া কমায়, চুলকে রক্ত ও মজবুত করতে সাহায্য করে। সেই সাথে এটি নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে থাকে। গাজরের বিদ্যমান ভিটামিন এ চুলের অকাল পক্কতা রোধ করে।
মস্তিষ্কের উন্নতি করতে
নিয়মিত গাজর খাওয়ার ফলে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। গাজরে বিদ্যমান ভিটামিন কে মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধের
গাজর একটি কম গ্লাইসোমিক ইনডেক্স (GI) খাবার হওয়ার কারণে এটি ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সাহায্য করে থাকে। এছাড়াও এতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বিদ্যমান থাকার পাশাপাশি চিনির পরিমাণ কম থাকে ফলে এটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য অনেক বেশি উপকারী।
বিষাক্ত পদার্থ অপসারণে
গাজর শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ অপসরণে কাজ করে থাকে। গাজরে বিদ্যমান ভিটামিন এ শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের করে দিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।
মুখ ও দাঁতের সুরক্ষায়
গাজর দাঁতের সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এটি দাঁত পরিষ্কারক হিসাবে কাজ করে। সেই সাথে এটি দাঁতের গোড়ায় ক্যালকুলাস জ্বলতে বাধা প্রদান করে থাকে। এছাড়াও এতে বিদ্যমান ক্যালসিয়াম দাঁতকে শক্ত ও মজবুত করতে সাহায্য করে। সেই সাথে এটি মুখের ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধ করে। হলে মুখে দুর্গন্ধ ও মুখের অন্যান্য সমস্যা থেকে মুখকে রক্ষা করে। এছাড়াও ইতি বিদ্যমান ভিটামিন সি দাঁত ও মাড়ির জন্য ভালো।
অ্যান্টিসেপটিক হিসেবে
গাজর অ্যান্টিসেপটিক হিসেবেও কাজ করে থাকে। অনেক সময় আমাদের শরীরের কোন অংশ কেটে গিয়ে সেখানে ইনফেকশন হয়ে যায়। তাই এর হাত থেকে রক্ষা পেতে ফেটে যাওয়া বা পুড়ে যাওয়া স্থানে গাজরের রস লাগিয়ে দিলে তার থেকে আর ইনফেকশন হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। কেননা গাজরের রস একটি ভালো অ্যান্টিসেপটিক।
কৃমির হাত থেকে রক্ষা করতে
অনেক সময় পেটে কৃমি দেখা যায়। বিশেষ করে শিশুদের এই সমস্যা বেশি দেখা যায়। এর থেকে মুক্তি পেতে ২০ থেকে ৪০ মিলি গাজরের রস তৈরি করে তা শিশুদের খাইয়ে দিন। দেখতে এতে করে কৃমির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ
নিয়মিত গাজরের সাথে রসুন মিশিয়ে খেলে তা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে থাকে। এছাড়াও গাজরের স্যুপ উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়রিয়া কমাতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে।
হাড় মজবুত করতে
গাজরে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন ডি, ভিটামিন কে ও ক্যালসিয়াম বিদ্যমান থাকে। এগুলো একত্রে হাড় মজবুত করতে সাহায্য করে থাকে।
হৃদরোগের সম্ভাবনা কমাতে
গাজরে প্রচুর পরিমাণ পটাশিয়াম বিদ্যমান থাকে যা হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে থাকে। সেই সাথে এতে বিদ্যমান বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট স্ট্রেস এবং প্রদাহ প্রতিরোধ করে হৃদযন্ত্রকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও নিয়মিত গাজর খাওয়ার ফলে রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমে যায়। ফলে হার্ট সুস্থ থাকে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা মতে যারা প্রতিদিন অন্তত একটি করে গাজর খেয়েছেন তাদের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি প্রায় ৬৮% পর্যন্ত কমে গিয়েছে।
গাজর খেলে কি ক্ষতি হয়
আমাদের অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে গাজরের এত এত উপকারিতার পরও কি এর কোন ক্ষতিকর দিক রয়েছে? এর উত্তর হলো হ্যাঁ, অবশ্যই। গাজরের নানাবিদ উপকারিতা থাকা সত্ত্বেও এর কিছু ক্ষতিকর দিক রয়েছে। বিশেষ করে কেউ যদি অতিরিক্ত পরিমাণ গাজর খেয়ে ফলে তবে তার নানা ধরনের সম্মুখীন হতে হয়। তাহলে চলুন গাজরের ক্ষতি সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক-
- গাজরে প্রচুর পরিমাণ ফাইবার বিদ্যমান থাকার কারণে অতিরিক্ত পরিমাণে গাজর খেয়ে ফেলে শরীরে ফাইবারের পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে পেট ব্যথা, পেট ফাঁপা, হজমের সমস্যা সহ পেটের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- অতিরিক্ত পরিমাণ গাজর খাওয়ার পরে কেউ যদি রোদে বের হয় তবে এতে বিদ্যমান বিটা ক্যারোটিন ত্বককে হলুদ বা কমলা রঙে পরিবর্তন করে দেয়। এই অবস্থাকে ক্যারাটিনেমিয়া বলে। যদিও এটি সাময়িক, তবুও ত্বকের রং পরিবর্তন হওয়ার কারণে অসস্তিবোধ হতে পারে।
- গাজরের মধ্যে রয়েছে অধিক পরিমাণ বিটা ক্যারোটিন। যার ফলে অতিরিক্ত গাজর খেলে শরীরে বিটা ক্যারোটিনের পরিমাণ বেড়ে যায়। আর এটি শরীরে ভিটামিন-এ তে রূপান্তরিত হয়। শরীরে ভিটামিন-এ এর পরিমাণ বেড়ে গেলে তা থেকে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়াও অতিরিক্ত বিটা ক্যারোটিন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
- অতিরিক্ত গাজর খাওয়ার ফলে ঘুমের নানাবিধ সমস্যা দেখা দিতে পারে। সেই সাথে রক্তচাপের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- গাজর বেশি খার ফলে অনেক সময় এলার্জির সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই যাদের এলার্জি সমস্যা রয়েছে তারা অতিরিক্ত গাজর খাওয়া থেকে বিরত থাকবেন।
- শিশুরা খুব বেশি গাজর খাওয়ার ফলে তাদের দাঁতের ক্ষয় হতে পারে।
- গাজরে সামান্য চিনি বিদ্যমান থাকার কারণে কেউ যদি অতিরিক্ত গাজর খেয়ে ফেলে তবে তার রক্তে শর্করার মাত্রা উঠানামা করে। তাই যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে তারা অতিরিক্ত গাজর খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
- যাদের হাইপো থাইরডিজম আছে তারা গাজর খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। কেননা এসব রোগীর ভিটামিন-এ এবং ভিটামিন-কে শোষণ করতে অসুবিধা হয়। আর গাজরে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন-এ বিদ্যমান।
- যেসব মহিলা বাচ্চাদের বুকের দুধ পান করান তাদের ক্ষেত্রে গাজর কম খাওয়াই ভালো। কেননা অতিরিক্ত গাজর খাওয়ার ফলে বুকের দুধের স্বাদ পরিবর্তন হতে পারে।
এছাড়াও যাদের ফুলের পরাগে এলার্জি রয়েছে তাদের গাজর পরিহার করাই উত্তম। তাছাড়াও দূষিত পরিবেশে উৎপাদিত গাজর ও অতিরিক্ত সার কীটনাশক ব্যবহার করা গাজর শরীরে নানা ধরনের ক্ষতি সাধন করতে পারে। তাই গাজর খাওয়ার পূর্বে অবশ্যই এটি ভালোভাবে ধুয়ে খাওয়া উচিত এবং পরিমাণ মতো খাওয়া উচিত। তাহলে এর থেকে উপকার পাওয়া সম্ভব।
গাজর খেলে কি ত্বক ফর্সা হয়
আমরা সকলেই সুস্থ, সজীব ও মসৃণ ত্বক পছন্দ করে থাকি। আর সেটি পাওয়ার জন্য নানারকম চেষ্টা করে থাকি। এমনকি আমরা ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়ে থাকে। কিন্তু এই কাজে আপনাকে সাহায্য করতে পারে গাজর। শুনে কিছুটা অবাক নেন তাই তো। আপনি ঠিকই শুনেছেন। গাজরে প্রচুর পরিমাণ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বিদ্যালয় থাকার কারণে এটি ত্বক উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত করতে সাহায্য করে।
আরো পড়ুনঃ করলা খাওয়ার ১০ টি উপকারিতা যা আপনার জীবন বদলে যেতে পারে - করলার পুষ্টি উপাদান সম্পর্কে জেনে নিন
গাজরে প্রচুর পরিমাণ পটাশিয়াম বিদ্যমান থাকে, যা ত্বকের ভিতরে পৌঁছে ত্বককে ময়েশ্চারাইজ করতে সাহায্য করে। এছাড়াও গাজর ত্বকের তৈলাক্ত ভাব দূর করতে কার্যকারী ভূমিকা পালন করে থাকে। গাজরে প্রচুর পরিমাণ পানি বিদ্যমান থাকার কারণে এটি ত্বকের সজীবতা ধরে রাখে এবং ত্বকে শুষ্কতার হাত থেকে রক্ষা করে।
আমরা এতক্ষণে সকলে জেনেছি যে গাজরে প্রচুর পরিমাণ বিটা ক্যারোটিন বিদ্যমান থাকে। যা আমাদের দেহে ভিটামিন-এ তে রূপান্তরিত হয়। তার এই বিটা ক্যারোটিন সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে আমাদের শরীরকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। এছাড়াও গাজরে বিদ্যমান অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরে মেটাবলিজম বাড়াতে কাজ করে থাকে। যার ফলে ত্বকের যে কোন সমস্যা মোকাবেলা করতে পারে।
এছাড়াও এটি ত্বকের টিস্যু মেরামতে কাজ করে থাকে। এছাড়াও গাজরের রস ত্বকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি প্রদান করে ত্বককে প্রাণবন্ত রাখতে সাহায্য করে। সেই সাথে গাজোরে তৈরি মুখোশ আপনার মুখের ত্বককে উজ্জ্বল করতে সাহায্য করতে পারে। তাই ত্বক উজ্জ্বল ও ফর্সা করতে গাজর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
গর্ভাবস্থায় গাজর খাওয়া যাবে কি
গাজরে প্রচুর পরিমাণ পুষ্টির প্রধান বিদ্যমান থাকার কারণে গর্ভাবস্থাতেও গাজর খাওয়া যেতে পারে। তবে তা অবশ্যই পরিমাণ মতো হতে হবে। গর্ভাবস্থায় গাজর খাওয়ার ফলে মা ও শিশু উভয়ের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে পারে। এছাড়াও ভ্রুনের বিকাশে গাজরে বিদ্যমান ভিটামিন বি, ক্যালসিয়াম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
গাজরে প্রচুর পরিমাণ ফাইবার বিদ্যমান থাকায় এটি মায়ের হজম শক্তি বৃদ্ধিতে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে থাকে। এছাড়াও পরিমিত পরিমাণ গাজর উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে থাকে। এছাড়াও গাজরে বিদ্যমান বিটা ক্যারোটিন ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে থাকে। তবে এটি শিশুর ত্বকের উজ্জ্বলতার ওপর কোন প্রভাব ফেলবে না।
গর্ভাবস্থায় গাজরের অনেক উপকারিতা থাকা সত্ত্বেও অধিক পরিমাণ গাজর খেলে বদহজমসহ বিভিন্ন ধরনের পেটের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এছাড়াও অতিরিক্ত গাজর খাওয়ার ফলে মায়ের বুকের দুধের স্বাদ পরিবর্তন হতে পারে। তাই গর্ভাবস্থায় গাজর খাওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন করে গাজর খাওয়া উচিত।
লেখকের মন্তব্য
আমরা এতক্ষন গাজরের উপকারিতা ও অপকারিতা সহ বেশ কিছু সম্পর্কে আপনাদের জানানোর চেষ্টা করেছি। আপনারা যদি সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে করে থাকেন তবে অবশ্যই তা বুঝতে পেরেছেন। গাজর আমাদের জন্য অনেক উপকারী হলেও এটি খাওয়ার সময় আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। কেননা অতিরিক্ত পরিমাণ খেয়ে ফেলে তা স্বাস্থ্যহানি ঘটাতে পারে।
প্রিয় পাঠক, এই আর্টিকেলটি আপনার কাছে এমন লেগেছে তা অবশ্যই আমাদের জানাবেন। এই আর্টিকেল সম্পর্কে কোন প্রশ্ন থাকলে তা কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। এই আর্টিকেলটি যদি আপনার ভালো লেগে থাকে তবে এটি আপনার পরিবার ও আত্মীয় স্বজনদের মাঝে শেয়ার করতে ভুলবেন না।
আপনি আপনার মূল্যবান মন্তব্যটি এখানে লিখুন। প্রতিটি মন্তব্য গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়।
comment url